ঢাকা, শুক্রবার   ২২ নভেম্বর ২০২৪

মানুষ ‘ডাহুক’ও বটে

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ১৪:০৩, ৬ আগস্ট ২০২০ | আপডেট: ১৪:২৭, ৬ আগস্ট ২০২০

বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. সেলিম জাহান কানাডা ও যুক্তরাষ্ট্রের একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেছেন। সর্বশেষ নিউইয়র্কে জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির মানব উন্নয়ন প্রতিবেদন দপ্তরের পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। এর আগে বিশ্বব্যাংক, আইএলও, ইউএনডিপি এবং বাংলাদেশ পরিকল্পনা কমিশনে পরামর্শক ও উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করেছেন। তার প্রকাশিত উল্লেখযোগ্য বই- বাংলাদেশের রাজনৈতিক অর্থনীতি, অর্থনীতি-কড়চা, Freedom for Choice প্রভৃতি।

ক’দিন আগে আমার এক বন্ধু আমাকে ‘ওহে’ বলে সম্বোধন করেছিল। ভারী ভালো লেগেছিল আমার- কতদিন পরে হারিয়ে যাওয়া শব্দটি শুনলাম। তবে তার আগে আমি তাকে ‘কে হে’ বলেছিলাম। লোপামুদ্রার ‘তোমরা কে হে’ গানের কল্যানে ‘কে হে’ মাঝে মধ্যে শুনতে পাই, কিন্তু ‘ওহে’ শুনিনি কত যুগ। আর কৌলীন্যে বোধহয় ‘কে হে’ র চাইতে ‘ওহে’ শ্রেয়তর।

সারা জীবনে কত যে সম্বোধনের মুখোমুখি হয়েছি, কত নামে যে মানুষ ডেকেছে - শৈশবে, কৈশোরে, যৌবনে এবং এখনও।

শৈশবে আমার নানা ডাকতেন ‘হুজুরে আলা’ বলে - বেশ খানদানী সুরে। বড় ফুপু ডাকতেন ‘বাপ’ বলে, কইতেন, ‘আমার বাপ নেই, তোকেই বাপ ডাকি’। বাবার বন্ধু এবং সহকর্মী বি.এম. কলেজের অর্থনীতির অধ্যাপক আমিনুল ইসলাম মজুমদার আমাকে ‘ফাদার’ বলে সম্বোধন করতেন। ভারী গুরুত্বপূর্ণ মনে হত নিজেকে।

কৈশোরে বরিশাল জিলা স্কুলে নরেন পন্ডিত মশায় আমাদের ‘ওহে বালক’ বলে সম্বোধন করতেন। মা’র বাক্স থেকে চুরি করা শরৎচন্দ্রের বইয়ে ‘ওহে’র ছড়াছড়ি ছিল। ‘বিপ্রদাস’ এ দেখেছি, বেশ মনে আছে। ‘দত্তা’তেও কি ‘ওহে বিলেস’ বলে রাসবিহারী হাঁক দেননি? বছরের প্রথমে হারান বাবুর বইয়ের দোকান থেকে নতুন শ্রেণির নতুন বই কিনে তার গন্ধ শুঁকতে গেলে হারান কাকা বলতেন, ‘ওহে, ওটা কোর না, ছাপাতে সিসে থাকে’। ষাটের দশকের মাঝামাঝি সতীর্থ বন্ধু মোফাজ্জল ‘গুরুদেব’ বলে ডাকত আমায়। তখন ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সময়ে ঢাকা বেতারে ‘হিং টিং ছট’ বলে দু’চরিত্র বিশিষ্ট একটি রম্য অনুষ্ঠান হতো - যার একটি চরিত্র ছিল ‘গুরুদেব’, যেখান থেকে ঐ ডাকের জন্ম।

বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়ে সম্বোধনের পুস্প পল্লবিত হয়ে উঠল- ছাত্রবাসে, বিভাগে, বিভাগের বাইরে। সলিমুল্লাহ ছাত্রাবাসে ৩৩ নম্বর সহকক্ষবাসী আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সেলিম শাহাবুদ্দীন আমাকে সম্বোধন করত ‘লোকটা’ বলে, কারন তার কিছুকাল আগে শিশুতোষ পত্রিকা ‘টাপুর টুপুরে’ আমার একটি ছড়া বেরিয়েছিল, যার প্রথম লাইনটি ছিল ‘লোকটা নাকি গাধার মতো’।

অন্য সহকক্ষবাসী রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের মন্টু ডাকত ‘কমরেড’ বলে, কারন তখন সে ভীষণভাবে বামপন্থী রাজনীতি করত। একবার আমি তাকে ‘বেশীরেড’ বলাতে বড়ই আহত হয়েছিল সে। ছাত্রাবাসের মাঠে একদিন প্রদর্শিত ‘অপুর সংসার’ দেখার পরে পাশের ঘরের ইতিহাস বিভাগের সতীর্থ সিরাজ আমাকে ‘অপূর্ব বাবু’ বলে সম্বোধন করতে শুরু করেছিল। কবুল করি, পুলকিত হয়েছিলাম সৌমিত্রের চেহারার সঙ্গে সাদৃশ্য আছে ভেবে। ‘বয়সটাই যে খারাপ’।

বিশ্ববিদ্যালয়ে শেখ কামাল এমন একটা নামে ডাকত তার স্হাপিত একটি সম্পর্কের ভিত্তিতে - বেনুকে তার বোন ধরে নিয়ে। তবে সেই সম্পর্ক আর তার ডাক নিয়ে সে গুবলেট করে ফেলেছিল। কিন্তু স্বীকার যেত না কিছুতেই। খুকু ডাকত ‘ফার্স্ট বয়’ বলে সন্মান পরীক্ষার ফল বেরুবার পরে। ঠাট্টা করে বলতাম, ‘অন্তত: একবার ‘ফার্স্ট ম্যান’ তো বলতে পারে’। হাসত সে। আমার সতীর্থ ছিল দু’জনেই।

বিভাগীয় শিক্ষক যখন হলাম, তখন ‘স্যার’ হয়ে গেলাম বেশীর ভাগের কাছে। ‘ভাই’ রয়ে গেলাম কাছাকাছি অনুজ শিক্ষার্থীদের কাছে। তবে আমার স্যার অধ্যাপক মুশাররফ হুসেন উল্টো আমাকেই স্যার সম্বোধন করতেন। ‘কি স্যার, শরীলডা ভালা তো? মনডা?’ - এ ডাক এখনো শুনতে পাই। অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক সম্বোধন করতেন ‘জনাব সেলিম জাহান বল’। মাহবুব ভাই (প্রয়াত ড: মাহবুব হোসেন) আমার পুরো নাম ধরে ডাকতেন, কখনও শুধু প্রথম নাম ধরে ডাকেননি।

পেশাগত জীবনে আনুষ্ঠানিক ডাক ‘ড: জাহান’ বা ‘প্রফেসর জাহান’- সেটাই ছিল প্রচলিত। জাতিসংঘ মানব উন্নয়ন প্রতিবেদন দপ্তরে ড: মাহবুবুল হক আমাকে সম্বোধন করতেন, ‘সবচেয়ে সুবেশ ভদ্রলোক’ বলে, অধ্যাপক অমর্ত্য সেন ডাকেন, ‘মানব উন্নয়নের হৃদয়’ বলে। জনান্তিকে জানিয়ে রাখি, ড: মাহবুবুল হককে তিনি বলেন, ‘মানব উন্নয়নের মস্তিষ্ক’ আর নিজেকে বলেন, ‘মানব উন্নয়নের বিবেক’। স্যার রিচার্ড জলি আমাকে ডাকেন, ‘মানব উন্নয়নের উচ্চ পাদ্রী’ বলে।

আর এখন সার্বজনীন ভাবে ‘স্যার’ বলেই সম্বোধিত হই। সারা জীবন ঐ সম্বোধনটি আমার পিতার জন্যেই বরাদ্দ ভেবেছি। এখন মনে হয়, বোধহয় জীবনরশির ওই বিন্দুতে পৌঁছেছি, যেখানে লোকে ঐ নামেই আমাকে ডাকবে। কিন্তু ভাবি, সত্যিকারের ‘স্যার’ ছিলেন আমার পিতা, আমি তো এক ‘অসার স্যার’। তবু বুঝতে পারি, ঐ ডাকের মধ্যে মানুষের শ্রদ্ধা-সম্ভ্রম আর ভালোবাসা মেশানো থাকে।

সারা জীবন এই যে এতো সম্বোধনে সম্বোধিত হয়েছি, তা ভাগ্য বলে মানি। নমিত হই এ সমৃদ্ধির কাছে। নানান সময়ের নানান ডাক হৃদয়ে ধরে রাখি, স্মৃতিতে জমা করি - কারন কোন কোন ডাক তো আর কখনও শুনতে পাব না এ জীবনে।

আসলে সম্বোধন তো শুধু নিছক ডাক নয়, একজন মানুষকে অন্য আরেক জনের কাছ থেকে পৃথক করার মামুলী কলকব্জাও নয়। ডাকের পেছনে মমতা থাকে, মায়া থাকে, স্মৃতি থাকে, ইতিহাস থাকে। ডাকেরও কথা থাকে, ডাকও কথা কয়। সে কারনে মানুষ ‘ডাহুক’ও বটে।

এমবি//
 


** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।
Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি